আজ “আমরা কক্সবাজারবাসী”র ৫ ম বার্ষিক মিলন মেলা।সফল মিলনমেলার মাধ্যমে আগামী দিনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে এগিয়ে যাবে, আশাবাদ সংগঠনটির সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের।
কক্সবাজারের কথা উঠলে প্রথমেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অধিকারী সমুদ্র সৈকতের বিশ্বখ্যাতির বিষয়টি এসে যায়।তবে এখন অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে তার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক লাবণ্য।কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের প্রেমে ছুটে আসে দেশী-বিদেশী পর্যটক।সাগর পাড়ে আসলেই পর্যটক মনে দোলা দেয়ার কথা সমুদ্রের গর্জন,জলকেলির বিরহী সুর,নীল জলরাশির নাচের মুর্চনা, ঝাউপাতার শনশন সুর আর গাঙচিলের ডানা দোলা।তখন মুগ্ধমোহনীয় আমেজে মনের ভুলে গুনগুনিয়ে হয়তোবা বলে উঠা,”দক্ষিণা বাতাস ফিসফিসিয়ে ভালবাসা জানায়,গাঙচিলেরা উড়ে বেড়ায় তোমার পাহারায়”।সৃষ্টির অকৃত্রিম সুধাপানে গেয়ে উঠে কবিতায়, “সাগর আমায় উদাস করে স্মৃতির পাতায় ডুব। নীল জলের গর্জনেতে মায়ায় পড়ি খুব”।কিন্তু আজকাল কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে সব। সাগরজলের আওয়াজকে নিস্প্রভ করে দেয় বালুচরে গড়া দোকানের কোলাহল এবং পিচ্চিদের,”কি নিবেন স্যার,কিছু লাগবে, আসুন দেখে যান”?অন্যদিকে অপরিকল্পিত সৌন্দর্য বর্ধনের ফলে নিজস্ব জৌলুষ হারাচ্ছে হ্নদয়স্নানের এই বদ্বীপের কিনারা।তাই বিশিষ্টজনের অভিমত সম্ভাবনাময় এই খাতটি নিয়ে এখন ভাবনার সময় হয়েছে।পর্যটন শিল্প নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণায় হতাশা প্রকাশ করে চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ। পত্রিকান্তরে দেখা যায়,পর্যটন শিল্পে ১৮৮ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম,আর এশিয়ার ৪৬ টি দেশের মধ্যে ৪২ তম,বিষয়টি উদ্বেগের নয় কি? অন্যদিকে বিশ্বের অনেক দেশগুলোতে পর্যটন শিল্পকে অর্থনৈতিক শক্তির অন্যতম খাত হিসেবে “তারকা চিহ্নিত” করে বিবেচনায় রাখছে । এমনকি রক্ষণশীল মরুদেশ সৌদি আরব পর্যন্ত এই শিল্প বিকাশে পর্যটকদের জন্য দোয়ার খুলে আইনকানুন শিথিল করেছে।কিন্তু প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্য নিয়েও বাংলাদেশ এই শিল্পকে বিকশিত করার পথে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।তাই নাগরিক সমাজের অভিমত, সময় হয়েছে এই শিল্পকেন্দ্রিক মুক্ত আলোচনা করার। কিন্ত কে ভাববে এসব নিয়ে?সরকার? নাকি বিরোধী দল?নাকি সুশীল সমাজ? নাকি আমজনতা? গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না সৈকতের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট মহল। সরকার ব্যস্ত উন্নয়নের বড় বড় প্রকল্পের কাজ নিয়ে।আর বিরোধীদল রয়েছে তাদের ভাষায় তথাকথিত গনতন্ত্র উদ্ধারের জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।বিভক্তি নিয়ে সুশীল মুরুব্বীরা। অধিকাংশ তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক সচেতন না হলেও রাজনৈতিক দলের পিছনে ঘুরছে। রাষ্ট্রবিজানের ভাষায় রাজনৈতিক সচেতন না হলে, নিজের মধ্যে বোধের জাগরণ হয় না,আর বোধের জাগরণ না হলে কি হবে সেই রাজনীতি দিয়ে?তাই রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে নানাবিধ রটনা ঘটনা,দখল বেদখল, টেন্ডারবাজী সহ হরেকরকমের অভিযোগ। ফলে আস্থা হারাচ্ছে রাজনৈতিক দলসমূহ।তাই প্রশ্ন এসে যায়, “আমরা কোথায় যাব? কার কাছে যাবো?এমন হতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কি দিতে পারবো আমরা।এরকম যখন হাল তখন সাধারণ মানুষের সামাজিক আন্দোলন ছাড়া বিকল্প পথ খোলা থাকে না।বিশ্লেষকদের অভিমত,” সচেতনতা হলো দীর্ঘস্থায়ী চলমান প্রক্রিয়া, যা একদিনে সবকিছু করা সম্ভব নয়।ক্রমান্বয়ে গণদাবীতে গণজোয়ার সৃষ্টি হলে সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে বাধ্য হন”।
মুষ্টিমেয় লুটেরা কিছু মানুষের আগ্রাসী থাবায় সৌন্দর্য হারাচ্ছে কক্সবাজার।জেলা জুড়ে অবাধে কাটা হচ্ছে পাহাড়, জবরদখলের কবলে বনভূমি। বীরদর্পে দখল করা হচ্ছে নদী।বালুখেকো ভূমিখেকোরা বীরদর্পে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কাজ।ফসলি জমির মাটি উত্তোলনের মাধ্যমে কৃষি জমির উর্বরতা হারিয়ে ফেলছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন এসে যায়। কিন্তু প্রশাসন কতৃক কঠোর হস্তে দমনে উদাসীনতা দেখা যায় সমস্ত জেলা জুড়ে। জিইয়ে আছে রোহিঙ্গা সমস্যা।এদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনো উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা রাখতে পারে নাই। উপরন্তু বিশ্বব্যাংক সহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ীকরণের জন্য কাজ করছে। বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছে ইসুটি তাদের চাকরি ও জীবিকার ধান্ধা হিসেবে নিয়েছে।ফলে কক্সবাজারের জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা সমস্যায় অতিষ্ঠ,আতংকিত ।
নৈতিক অবক্ষয় যেন বায়ুবেগে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজেদের প্রাপ্তির জন্য আমারা সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি।শুধু টাকার পিছনে দৌড়াচ্ছি আমরা। টাকার জন্য মানসম্মান আত্মমর্যাদাবোধ বিকিয়ে দিচ্ছে । সমাজ এবং দেশকে নিয়ে কি ভাবছি আমরা?নানাকারণে আমাদের সমাজে মেধাবী আদর্শনিষ্ট,সত্যও নীতিপরায়ন মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে প্রগতিশীল চিন্তার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। কক্সবাজারে উদার রক্ষণশীল সমাজের আইডল নষ্টদের কারণে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নানাবিধ সমস্যার চোরাবালিতে আটকে এই জনপদ।মাদক সমস্যা মহামারী রুপে কক্সবাজারে কলংকের তিলক হয়ে উঠছে।মাদক নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের পাশাপাশি নাগরিকদের দায়বদ্ধতার কথাটি স্মরণ করে দিয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে যুবসমাজসহ সকলকে রক্ষায় এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
কক্সবাজারের নতুন কউক ভবন উদ্ভোদনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “কক্সবাজার একটি চমৎকার জায়গা, কক্সবাজারবাসীর কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে, যেখানে সেখানে যত্রতত্র কোন স্থাপনা করবেন না।পুরো কক্সবাজার জুড়ে একটি মাষ্টারপ্ল্যান করার নির্দেশ দিয়েছি। এর উন্নয়নটা যাতে অপরিকল্পিত ভাবে না হয়ে পরিকল্পিত ভাবে হয়”। উল্লেখ্য যে,কউক ভবনটি নির্মাণ শেষ হওয়ার পরও বরাদ্দকৃত অনেক টাকা রয়ে যায়, সে টাকা গুলো পাইপাই হিসাব করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেছিলেন তত্কালীন কউক চেয়ারম্যান লেঃ কর্ণেল (অবঃ) ফোরকান আহমেদ।
তাই বলা চলে যে, কউক ভবনটি সততার বার্তা হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। ভূমিপুত্র ফোরকান সাহেব ” আমরা কক্সবাজারবাসী” সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা। কক্সবাজার নিয়ে মহাপরিকল্পনার অন্যতম রুপকার তিনি।
কক্সবাজার হলো প্রবাসী অধ্যাসিত জায়গা। হাজার হাজার মানুষ বিদেশ গিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহে গতি বাড়াচ্ছে। প্রতিনিয়ত দেখা যায়, প্রবাসী পরিবারের উপর অত্যাচার নিপীড়নের খবর। তাদের সহায় সম্পদ জোরদখল প্রতারণা নিয়ে একটি মহল লেগেই আছে। ।আইনি দীর্ঘসূত্রের কারণে প্রশাসনমুখী হতে ভয় পায় তারা।এই সংগঠন অসহায় প্রবাসীদের পাশে দাড়াতে পারে।জেলে সমাজ আমাদের জাতীয় সম্পদ। বিশাল সাগরে তাদের জানমালের নিরাপত্তার পাশাপাশি ইঞ্জিন চালিত ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল টহলে রাখার দাবি জানাচ্ছি সংশ্লিষ্টদের কাছে।
২০১৭ সালে নাজিম উদ্দীন এবং মহসিন শেখ সহ সমমনা দশজন সদস্য নিয়ে “আমরা কক্সবাজারবাসী”র যাত্রা। ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সংগঠনের নীতিনির্ধারকদের একজন বলেন ,”আমরা ভালবাসি বাংলাদেশকে, আমরা আমাদের কক্সবাজারকে ভালবাসি এই শ্লোগানে সবাইকে এককাতারে এসে দাড়াতে হবে।তাঁর জন্য নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা কক্সবাজারের প্রতিনিধিত্বশীল সকল সামাজিক সংগঠন পরিবর্তন নিয়ে কাজ করলেই বর্তমান সংকটের গুনগত পরিবর্তন আসবে।আগামী প্রজন্মের কাছে নিরাপদ নগরী রেখে যাওয়া আমাদের দায়বদ্ধতার অংশ” এবং আমরাই সরকারের টেকসই উন্নয়নের পাহারাদার।
————————
বদরুল ইসলাম বাদল
কলামিস্ট ও সমাজকর্মী