এম আর আয়াজ রবি::
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসার দিন। ভ্যালেন্টাইনস ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এদেশে ঠিক কবে ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণ হয়েছিলো ঠিক দিন তারিখ মনে না পড়লেও ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে প্রথিতযশা লেখক, কলামিস্ট সাপ্তাহিক যায় যায় দিন ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও বর্তমান যায় যায় দিনের সম্পাদক, জনাব শফিক রেহমানের হাত ধরেই প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস প্রথমে উদযাপিত হয়েছিল- এ ব্যাপারে কারো উজর আপত্তি নেই নি:সন্দেহে।
‘ভালোবাসা’ এমন এক তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ বা মায়াজাল, যার গভীরতা প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গহবরকেও হার মানাবে। ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবী অচল। এটিকে চর্চা করতে হয়, বুকে লালন এবং হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। হৃদয়ের অন্ত:করণ দিয়ে দেখলেই কেবল ভালোবাসায় উর্বরতা আসে, আসে হৃদয়ের মমত্ববোধ। না হলে অযত্নে হারিয়ে যায়, শুকিয়ে যায় ভালোবাসাহীন বৃক্ষ। ভালোবাসার গুণেই প্রভুকে পাওয়া যায়। মানুষ আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হয়। জ্ঞান–মেধার চর্চা ভালোবাসা ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটিভ্লিখ তোমার মনের মন্দিরে’- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানের মতো রোমান্টিক গান আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলেরও অনেক আছে। বলা যেতে পারে ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেবো খোঁপায় তারার ফুল’ কিংবা ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ’ গান দুটির কথা। দুই কবিরই অসংখ্য ভালোবাসার গান রয়েছে- যেগুলোর আবেদন চিরন্তন। এসব গানকেই আমরা বলছি চিরন্তনী গান।
বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে ১৪ ফেব্রুয়ারী দিনটিকে খুব ঘটা করে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। এই দিনে পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো ভালোবাসার মানুষে পরিপূর্ণ থাকে। ভালোবাসা দিবসের এই দিনে প্রিয়জনকে সবাই ফুল ও বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দিয়ে থাকে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস কয়েক বছর আগ পর্যন্তও বিশ্বব্যাপী ঘটা করে পালন করা হতো না।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের সুচনা নিয়ে বিভিন্ন মতাদর্শ রয়েছে।
ইতিপুর্বে এ দিবসটি যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্য সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে দিবসটি বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে আনন্দ উন্মাদনার সঙ্গে পালন করা হয়। প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেবদেবীর রানী জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত। কারও কারও মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারণ ছিল এটিই। আবার কেউ বলেন, রোমের সম্রাট ক্লডিয়াস ২০০ খ্রিস্টাব্দে দেশে বিয়ে প্রথা নিষিদ্ধ করেন। তিনি ঘোষণা দেন, আজ থেকে কোনো যুবক বিয়ে করতে পারবে না। যুবকদের জন্য শুধুই যুদ্ধ।
তার মতে, যুবকরা যদি বিয়ে করে, তবে যুদ্ধ করবে কারা? সম্রাট ক্লডিয়াসের এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ করেন এক যুবক। যার নাম ভ্যালেন্টাইন। অসীম সাহসী এ যুবকের প্রতিবাদে খেপে উঠেছিলেন সম্রাট। রাজদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তাকে। ১৪ ফেব্র“য়ারি ভোরবেলা মাথা কেটে ফেলা হয় তার। ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে তখন থেকেই এ দিনটিকে পালন করা হয় ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে। তবে এটিও সর্বজনস্বীকৃত নয়। এখানেও দ্বিমত আছে।
কার কারও মতে, প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি রোগীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সদয়। অসুস্থ মানুষের ওষুধ খেতে কষ্ট হয় বলে তিনি তেতো ওষুধ ওয়াইন, দুধ বা মধুতে মিশিয়ে খেতে দিতেন। সেই ডাক্তার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন।
প্রাচীন রোমে খ্রিস্টধর্ম তখন মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেয়া হতো। একদিন রোমের এক কারাপ্রধান তার অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ভ্যালেন্টাইন কথা দিয়েছিলেন তিনি তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করবেন। মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল এমন সময় হঠাৎ একদিন রোমান সৈন্যরা এসে ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়।
ভ্যালেন্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন, খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হবে। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্র“য়ারি রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তার আগে ভ্যালেন্টাইন অন্ধ মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তাকে হত্যার পর কারা প্রধান চিরকুটটি দিয়েছিলেন মেয়েটিকে।
তাতে লেখা ছিল, ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন (From your Valentine)। মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল কারণ এরই মধ্যে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির অন্ধ দুচোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল। ভালোবাসার এসব কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে এই দিনটিকে মানুষেরা ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করে আসছে।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে এর উৎপত্তির বিষয়ে কয়েকটি সম্পূর্ণ আলাদা মত রয়েছে। এই মতের লোকেরা বলেন, ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রিয়জনকে ভালোবাসার বার্তা পাঠানোর আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, ১৪ ফেব্রুয়ারি হল পাখিদের বিয়ের দিন। পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে। আবার কেউ বলেন, মধ্যযুগের শেষদিকে মানুষ বিশ্বাস করত এদিন থেকে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়। পাখিরা সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি মানুষও তাই সঙ্গী নির্বাচন করে এ দিনে।
৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্টাইন্স ডের উদ্ভব হলেও এটি বিশ্বব্যাপী প্রথম দিকে তেমন প্রচার ও প্রসার লাভ করেনি। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য।
তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা বিরত থাকে না। খ্রিস্টীয় চেতনা ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইন্স উৎসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন করা নিষিদ্ধ করেছিল। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি জনগণ ও সরকারিভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।
বর্তমান সময়ে ভ্যালেন্টাইন্স দিবসের কদর প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা এই দিবস উপলক্ষে এই দিনে প্রায় কয়েক কোটি ডলার ব্যয় করে।
আমরা চাই ভালোবাসা শুধুমাত্র একটি দিবসকে কেন্দ্র করেই শুধু আবর্তিত না হয়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ, মুহুর্ত, সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস ও বৎসর যেনো ভালোবাসার চাদরে মানবতা ঢেকে যাক। দেশে দেশে যুদ্ধ হাঙ্গামা, বন্ধ হোক। ইসরায়েল ফিলিস্তিন, রাশিয়া ইউক্রেনসহ সারা বিশ্বে চলমান প্রায় ৩২ টি দেশের যুদ্ধাবস্থা থেকে পরিত্রান পেয়ে ভালোবাসায় স্বপ্ন সাধে রঙীন হোক সারা বিশ্ব।
(সুত্র: পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম)